কেক পেস্ট্রির সম্ভার আঁকড়ে আজও দাঁড়িয়ে 'সালদানহা বেকারি'

প্রতিবারের মতো হিমেল কোলাহল নিয়ে এসে পড়েছে শীত। দু দুটো লকডাউন আর করোনাকালের সতর্কতাবাণী কে একপাশে রেখে উৎসবের আলোয় সেজে উঠেছে নাগরিক জীবন। খাওয়া ছাড়া উৎসব বৃথা তা কে না জানে? সে দুর্গাপুজোর সময় রাস্তার ধারের রোল চাউমিন হোক বা ঈদের কালে জাকারিয়া স্ট্রিট, কলকাতাবাসীর পেটপুজো চলতেই থাকে। আর এই খাদ্যপ্রিয় কলকাত্তাইয়াদের ভোজন সংস্কৃতির অতীত মেজাজ আঁকড়ে আজও সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো কলকাতার ‘সালদানহা বেকারি’। 

রফি আহমেদ কিড়ওয়াই  রোড ধরে কিছুটা সামনে এগোলেই চোখে পড়বে একটা হলুদ বিস্তৃত পাঁচিল, উপরে লাল অক্ষরে সযত্নে লেখা ‘সালদানহা’। ভিড় সেখানে লেগেই থাকে, অষ্টপ্রহর মেলা গাড়ি ঘোড়ার গ্যাঞ্জাম। এরই মধ্যে আপনাকে সিঁড়ি ধরে উঠে যেতে হবে দোতলায়। অবশ্য শুনে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, আদতে গোটা প্রক্রিয়াটা ঠিক ততটা সরল নাও হতে পারে। বড়দিনের আগে প্রায় যে কোনো সময়েই সিঁড়িতে লেগে থাকে লম্বা লাইন। সকলেই অপেক্ষমান, নিজের সৌভাগ্যের খাদ্যপেটিকাখানা হাতে নেওয়ার জন্য। এদের অধিকাংশই ‘সালদানহা’র নিয়মিত গ্রাহক। এখন অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারে এ বেকারির নাম দূর দূরান্ত অবধি ছড়িয়েছে, ফলত নানান অঞ্চল থেকে মানুষজন স্বাদের ভাগ নিতে এসে উপস্থিত হচ্ছেন। যাই হোক, লাইনে দাঁড়িয়ে খানিক শীতঘাম ঝরিয়ে অবশেষে আপনি উপরে উঠলেন। কী ভাবছেন? দেখবেন দোকানের লম্বাটে শো কেস, তাতে থরে থরে সাজানো খাদ্যসামগ্রী, ওপারে ব্যস্ত হাতে কাজ সামলাচ্ছে একাধিক দোকানী? আজ্ঞে না হুজুর।

মেঝে জুড়ে খবরের কাগজের আসন বিছনো, তার উপরেই পশরা সাজিয়ে বসেছেন কর্মচারীরা। এদিক ওদিক ডাঁই করে রাখা ফ্রুট কেকের ভিড়, বাতাসে ভ্যানিলা এসেন্সের গন্ধ ভরপুর। এরই মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য চলছে, আগ্রহী খরিদ্দারদের সাথে হাসিমুখে কথাবার্তা বলছেন বেকারির মালিকপক্ষ। এ বেকারির বিবর্তন ধারার যে প্রচলিত গল্প পাওয়া যায়, তাও রীতিমত আগ্রহ জাগায়। ১৯৩০ সাল। গোয়া থেকে এক পরিবার এসে পৌঁছল কলকাতায়, কাজের সন্ধানে। তারপর কীভাবে যেন জড়িয়ে পরল বেকারি ব্যবসায়। সেখান থেকেই শুরুওয়াত। বেকারির প্রথম কর্ণধার মিঃ সালদানহার যদিও এ ব্যবসায় আচমকা জড়িয়ে পড়ার কথা তাঁর ছিল না। তিনি পেশায় ছিলেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, এবং তাঁর কন্যা দেবোরা অ্যালেকজ্যান্দ্রা ছিলেন ব‍্যাঙ্কার। তারপর দেশ স্বাধীন হল, সালদানহাদের সুখাদ্য পরিবেশনার কাজ চলতে থাকল।

বর্তমানে বেকারির দায়িত্বে আছেন দেবোরার কন্যা, আলিশা অ্যালেকজ্যান্দ্রা। বিলেত থেকে পড়াশুনো সেরে ফিরে তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছেন পারিবারিক বাণিজ্যের ঘোড়দৌড়ের ব্যাটন। খাদ্যগুণ বাদেও ‘সালদানহা’র অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তার খাদ্যমূল্য। আশ্চর্য সস্তা দামে গ্রাহক এখানে পেতে পারেন ওয়ালনাট কেক, আলমন্ড কেক, ম্যাকরুন, চিজ পাফের মতো অভিনব খাবার দাবার। এ ছাড়াও হাল ফ্যাশনের সাথে তাল মেলাতে প্রধানত আলিশার পরিকল্পনাতেই সংযোজিত হয়েছে কে এফ সি চিকেন বাকেট কেকের মতো দ্রব্য। সাবেক ধাঁচের নীলচে সাদা বাক্স, উপরে গাঢ় নীল রঙে লেখা বেকারির নাম, খুললেই ছড়িয়ে পড়বে এক ঘর সুগন্ধ।

কেক পেস্ট্রি ছাড়াও ‘সালদানহা’র নিয়মিত ক্রেতাদের অনেকেই আসে দৈনিক পাঁউরুটি সংগ্রহ করতে। ‘হোম বেকারি’র রুটির স্বাদের যে নিজস্ব ছাঁচ ‘সালদানহা’ তৈরি করেছে তার জুড়ি অন্যত্র মেলা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, সে সম্বন্ধে পাঠক নিশ্চিন্ত হতে পারেন। গৃহলালিত কেক পেস্ট্রির যুগ অবলুপ্তপ্রায়। আজেকের দিনে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে নামকরা সব ব্র‍্যান্ড, ঝাঁ চকচকে তাদের বহিরঙ্গ। এ অবস্থায় ‘হোম বেকারি’র পুরনো ঐতিহ্য প্রত্যহ সযত্নে রক্ষা করছে ‘সালদানহা বেকারি’। বড়দিনের কেক প্রস্তুতকারী পুরনো দোকানপাটের অভাব কলকাতা শহরে হওয়ার কথা নয়। যীশু খ্রিষ্টের জন্মদিবস এগিয়ে এলেই কলুটোলা লেনের মন্টুর বেকারির ওভেনের আঁচ বৃদ্ধি পায়। ঔপনিবেশিক কাল থেকে দক্ষিণ কলকাতার বো ব্যারাক্সে অবস্থিত তাদের দোকান জে এন বড়ুয়ার কাটতির প্রাবল্য অব্যাহত রয়েছে আজও। এ ছাড়াও আছে ‘নাহুমস’। হগ মার্কেটের আলোকোজ্জ্বল এ দোকানের আছে কলকাতার প্রাচীনতম ইহুদি বেকারির তকমা। দুপুর পেরিয়ে বিকেলের মধ্যে আজকের দিনেও দোকানের কাঁচঘর প্রায় নিভু নিভু হয়ে আসে, কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। এদের পাশেই সমান তালে আসন দখল করে উপবিষ্ট ‘সালদানহা’। ইতিবৃত্তরা সময়ের ফেরে ফিকে হয়ে আসে, জায়গা করে নেয় তারা ইতিহাস গ্রন্থে। ‘সালদানহা বেকারি’ শহর কলকাতার ইতিবৃত্তের এক অন্যতম আকর, একে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্য।

More Articles